কীভাবে প্রেম পরিণত হল ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের আগুনে? জানুন।কীভাবে প্রেম পরিণত হল ভয়ঙ্কর প্রতিশোধের আগুনে? জানুন।Live in Partner Forensic Killer: ২১ বছরের সুন্দরী, শিক্ষিতা তরুণী। মাঝে মাঝেই রিলস করেন। খুনে অভিযুক্ত। শেষেরটা শুনে হোঁচট খেলেন? আসলে, ঠিক এমনই অবস্থা পুলিশেরও। এতটা প্ল্যান করে, সাজিয়ে যে কেউ খুন করতে পারে, সেটাই ভাবতে পারছেন না তাঁরা। ৩২ বছর বয়সী লিভ ইন পার্টনারকে খুনে অভিযুক্ত অমৃতার কাহিনী হার মানাবে ওয়েব সিরিজকেও। আর সেই কারণেই বর্তমানে দিল্লির সবার মুখে মুখে ঘুরছে তিমারপুরের ঘটনা। গান্ধী বিহারের সেই ফ্ল্যাট যেন এক ভয়ঙ্কর নরককুণ্ড। গত ৬ অক্টোবর রাতে সেই ফ্ল্যাটেই আগুন লেগেছিল। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে লেলিহান শিখা। ফায়ার ব্রিগেড এসে আগুন নেভায়। দরজা খুলতেই দেখা যায় মেঝেয় পড়ে এক যুবকের দগ্ধ দেহ।
মৃত UPSC অ্যাসপিরান্ট রামকেশ
নাম রামকেশ মীণা। বয়স ৩২। ওই ফ্ল্যাটেই থাকতেন। UPSC পরীক্ষার(যেটা দিয়ে IAS, IPS হয়) প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। দমকল আধিকারিকদের প্রথমে তেমন সন্দেহ হয়নি। শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে বলেই ভেবেছিলেন। দরজাও বাইরে থেকে আটকানো ছিল। কিন্তু পুলিশের চোখ এড়ানো অত সহজ নয়। ফ্ল্যাটটা একটু তল্লাশি করতেই সন্দেহ জাগে দুঁদে অফিসারদের। বেশ কিছু প্রশ্নের কোনও উত্তর মিলছিল না। এরপরেই ডেকে পাঠানো হয় ফরেন্সিক টিমকে। আর তারপরেই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসে।
অগ্নিকাণ্ড নয়, খুন
ফরেন্সিক টিম ঘরের প্রতিটি অংশ খতিয়ে দেখে। দেখা যায় বাড়িতে সবই অক্ষত। খালি যুবকের ল্যাপটপ, কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক নেই। শুধু তাই নয়, বডিটা যেভাবে পুড়েছে, সেটাও স্বাভাবিক নয়। গায়ে যেন কেউ তেল মাখিয়ে দিয়েছিল। এরপরেই সিসিটিভি ফুটেজ ঘাঁটতে শুরু করে পুলিশ। আর তাতে যা দেখা গেল, তাতে হাড়হিম হয়ে গেল পুলিশ অফিসারদেরও।
দেখা গেল, আগুন লাগার ঠিক কিছুক্ষণ আগেই ফ্ল্যাটে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে ঢুকছে। দু'জনেরই মুখ ঢাকা। আরও একজন যুবক ঢুকেছিলেন। তবে তাঁকে সিসিটিভিতে দেখা যায়নি। সম্ভবত অন্য পথে ঢুকেছিলেন।
রাত ২টো ৫৭ মিনিটে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তার ঠিক কয়েক মিনিট পরই আগুন লাগে। এতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এটি দুর্ঘটনা নয়, একেবারে পরিকল্পিত খুন। কিন্তু এরই মধ্যে একটি জিনিস নিয়ে খটকা লাগছিল পুলিশের। সেটা কী?
রামকেশের ঘরের দরজার গ্রিল ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। যেন কেউ ভিতর থেকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। সেটাই যদি হয়, তাহলে ওই যুবক, যুবতী বের হলেন কীভাবে?
ফরেন্সিক সায়েন্সের ছাত্রী, ক্রাইম ওয়েব সিরিজ দেখতেন
এবার সেই দরজা নিয়েই উঠে পড়ে লাগে ফরেন্সিক টিম। আর তখনই দেখা গেল গ্রিলটি একটি জায়গায় অল্প বাঁকানো হয়েছে। আর সেই ফাঁকটুকু দিয়ে অনায়াসে হাত ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া যায়।
ইতিমধ্যে এখনকার ও আগের সিসিটিভি খতিয়ে মেয়েটির পরিচয় মেলে। জানা যায়, তাঁর নাম অমৃতা চৌহান, বয়স ২১। মুরাদাবাদের মেয়ে। ফরেন্সিক সায়েন্সে বি.এসসি পড়ছেন। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা জানান, মৃত ৩২ বছরের যুবকের সঙ্গেই লিভ ইন করতেন তিনি। আর অপর জন? সেই অমৃতারই প্রাক্তন প্রেমিক সুমিত কশ্যপ (২৭)।
১২ দিনের তদন্ত শেষে গত ১৮ অক্টোবর অমৃতাকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ। মোবাইলের শেষ লোকেশনও ছিল ওই ফ্ল্যাটের আশেপাশেই।
পার্সোনাল ছবি ভাইরাল করার হুমকি?
জেরার মুখে ভেঙে পড়েন অমৃতা। তিনি জানান, রামকেশ(মৃত যুবক) তাঁর বয়ফ্রেন্ড ছিলেন। এক ফ্ল্যাটে থাকতেন তাঁরা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে। অমৃতা চাইছিলেন ব্রেক আপ করে নিতে। কিন্তু রাজি ছিলেন না রামকেশ। তাঁদের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে রেখেছিলেন মোবাইল ও হার্ড ড্রাইভে। সেগুলি কিছুতেই ডিলিট করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। রিলেশন ভাঙলে সেগুলি ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিতেন রামকেশ, দাবি অমৃতার।
এদিকে অমৃতার এর আগেও রিলেশনশিপ ছিল। সেই এক্স বয়ফ্রেন্ডের নাম সুমিত কশ্যপ। এমন পরিস্থিতিতে তিনি সুমিতের সঙ্গে ফের যোগাযোগ করেন। আর তখনই সুমিত প্রতিশ্রুতি দেয়, 'আমি সব ঠিক করে দেব।' এরপরেই খুনের প্ল্যানিং করেন তাঁরা।
সেই রাতের ভয়ঙ্কর স্ক্রিপ্ট
৫ অক্টোবর রাত। অমৃতা, সুমিত ও তাদের বন্ধু সন্দীপ রামকেশের ঘরে যায়। তিনজনে মিলে প্রথমে তাঁর গলা টিপে খুন করে। তারপর ঘরের সব তেল, ঘি, মদ ঢেলে দেয় বডিতে।
সুমিত একসময় LPG সিলিন্ডার(Cooking Gas) ডিস্ট্রিবিউটরের কাজ করত। তাই গ্যাস সিলিন্ডারের খুঁটিনাটি সে ভালই জানত। প্ল্যান মতো সুমিত গিয়ে রান্নাঘরের সিলিন্ডারের ভাল্ব খুলে দেয়। যাতে, বিস্ফোরণ হলে সবাই ভাবে, এটি সাধারণ গ্যাস লিকের ফলে দুর্ঘটনা। আর তাতেই মৃত্যু হয়েছে সুমিতের।
ফরেন্সিক জ্ঞানের অপব্যবহার
অমৃতা নিজের ফরেন্সিক বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। আর সেই জ্ঞান ব্যবহার করেই খুনকে ‘দুর্ঘটনা’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। বাইরে থেকে গ্রিল, দরজা বন্ধ করে দেওয়ার বুদ্ধিটা তাঁরই ছিল। কিন্তু পুলিশ যে এই ঘটনায় সিসিটিভি খতিয়ে দেখবে, তা তাঁরা ভাবেননি। ভেবেছিলেন আগুন লাগার ঘটনা ভেবেই এটা উড়িয়ে দেওয়া হবে।
পুলিশের বক্তব্য
দিল্লি পুলিশের এক সিনিয়র অফিসার বলেন, 'পড়াশোনা জানা অপরাধীই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। তাঁরা শুধু অপরাধই করে না, সেটাকে নিখুঁতভাবে সাজায়। এই ঘটনায় এক ফরেন্সিক ছাত্রী এক ভয়াবহ খুন লুকোতে নিজের জ্ঞান ব্যবহার করেছেন।'
এই ঘটনায় দু'টি বিষয় ফের ভাবাচ্ছে সকলে। প্রথমত, গত কয়েক বছরে একাধিকবার এমন লিভ ইন পার্টনার খুনের ঘটনা সামনে এল। আর দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত মানুষও খুন এড়াতে কীভাবে চিত্রনাট্য সাজাতে পারে। কীভাবে এক সময়ের প্রেম পরিণত হয় প্রতিশোধের আগুনে ও ঝলসে ওঠে ভয়ঙ্কর পরিণতিতে।